বাড়িটা আমরা পছন্দ করতাম, প্রাচিন এবং বিশাল তো বটেই তাছাড়াও, (ঐ সময়ে পুরনো বাড়ি ঘর-দোর ভেঙ্গে ফেলবার একটা হিড়িক চলছে চারিদিকে, কারণ নিলামে বাড়ির নির্মান সামগ্রীর বেশ চড়া দাম পাওয়া যেত) এখানে আমাদের বাপ-দাদা চোদ্দ গুষ্টির স্মৃতি জড়িয়ে আছে, আমাদের গোটা শৈশবের স্মৃতি এখানেই।
আইরিন আর আমি এই বাড়িটাতে থাকতে থাকতে এখানেই থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, পাগলামী আর কি। জনা আস্টেক মানুষ জন স্বচ্ছন্দে বাড়িটাতে বসবাস করা যায়, তাতেও কেউকে কারো পথ মাড়াতে হবে না। সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পরিস্কার পরিচ্ছনতার কাজ শেষ করে বেলা এগারোটা নাগাদ আইরিন ঘরদোরের বাদ বাকি কাজ সেরে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতো। দুপুরের খাওয়াটা দুজনে মিলে সেরে ফেলতাম একেবারে সঠিক সময়। এইতো ব্যাস, তারপর আর কয়েকটা এঁটো বাসনপত্র ধুঁয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। ওই শূন্য নিস্তব্ধ বাড়িটাতে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা সারতে সারতে খাওয়া, আহা খুবই আনন্দদায়ক। সত্যি বলতে কী, বাড়িটা শুধু পরিষ্কার রাখাটাই অনেক বড় এক ব্যাপার। মাঝে-মধ্যে ভাবতে বসলে মনে হতো এই একটা ব্যাপারই আমাদের বিয়ের পথে বাঁধ সেধে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই আইরিন দু-দুটো ভালো পাত্রকে নাকচ করে দিলো আর ওদিকে মারিয়া এসথার তো আমার বাগদত্তা হবার আশায় বসে বসে প্রায় মরেই যাচ্ছিল! আমরা দিনে দিনে পৌছে গেছি চল্লিশের কোঠায়, এই বাড়িটায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিজের ভাই বোনদের বিয়ে-শাদির ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন ছিলেন, সেই না-বলে যাওয়া মনোবাঞ্ছার ভার মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি আমরাও। এই বাড়িতেই কোনোদিন আমরা মারা যাব, কোনো এক অচেনা অজানা দূর সম্পর্কের -তুতো ভাই এসে উত্তরাধিকারী সূত্রে বাড়িটা দখল করে নিয়ে বসে বসে বংশ বিস্তার করবে, নয়তো বাড়িটা ভেঙে ফেলে ইট-কাঠ সব খুলে খুলে বিক্রি করে বড়োলোক হয়ে যাবে এই দালানের জায়গাটাতেই; তার চেয়ে ভালো আর বুদ্ধিমানের কাজ হলো আর বেশী দেরি না করে আগে ভাগে নিজেরাই ডিগবাজি খাওয়া।
আইরিন কখনোই কাউকে বিরক্ত করতো না। সকালবেলাটায় ঘরের কাজ-কাম সেরে নিয়ে গিয়ে বসতো নিজের শোবার ঘরের সোফায়, বসে বসে উল বুনতো। বুঝি না ও এত সোয়েটার বোনে কেনো। আমার ধারনা মেয়েরা আসলে কাজ-কাম না করার অজুহাত হিসেবে দিনভোর উল বোনে। তবে আইরিন ঠিক ওরকম মেয়ে নয়। সে সবসময়ই দরকারি পোশাক-আশাকই বুনত। শীতের সোয়েটার, আমার জন্য মোজা, নিজের জন্যে সকালে পরার ঢিলে-ঢালা লম্বা জামা, আর রাতে পরে শেবার গরম কাপড়। কখনো সখনো আবার একটা জ্যাকেটকিছুটা বুনে ফেলে পরক্ষণেই টেনে টেনে উল খুলে ফেলতো, মানে ওটার কিছু একটা হয়তো ওর মনমতো হয় নি; কয়েক ঘন্টা ধরে যুদ্ধ করে শেষে পরাজিত কোঁচকানো উলের স্তূপ পড়ে আছে ওর সেলাইয়ের ঝুড়িতে, দেখতে ভালোই লাগত। শনিবার শনিবার করে আমি উল কিনতে যেতাম শহরে। আমার পছন্দের উপর আইরিনের ভরসা ছিল। আমার নেওয়া রঙগুলো ওর পছন্দই হতো, তাই কখনোই কোনো উলের গোল্লা ফেরত দিতে হয়নি। এই অজুহাতে কিছুটা সুযোগ নিতাম আমিও, বইয়ের দোকানে গুলোতে খানিকক্ষণ ঘুরে ফিরে আসতাম। খামোখাই জানতে চাইতাম ফরাসি সাহিত্যের নতুন কিছু এসেছে কি না। ১৯৩৯ সালের আগে পড়ার মতো কোনো বই-ই আর্জেন্টিনায় আসেনি।
সে যাকগে, বলছিলাম আমাদের বাড়িটার কথা। বাড়ি আর আইরিন; আমি এখানে তেমন মুখ্য কিছু নয়। বড় অবাক লাগে, উল বোনা ছাড়া আইরিন বেচারীর সারাটাদিন কাটবেই বা কী করে। একবার পড়া বই আরেক বারও পড়া যায়, কিন্তু একটা পুলওয়ানর একবার বুনে শেষ করে তা তো আবার নতুন করে বানানো যায় না, মানে একেবারে যাচ্ছেতাই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় আর কী। একদিন ওর শোবার-ঘরে কাপড়-চোপড় রাখবার ওয়াড্রবের নিচের ড্রয়ার খুলে দেখি ন্যাপথলিন দিয়ে রাখা সাদা, সবুজ, লালচে-বেগুনি শালে ঠাসা। চাদরের সেই স্তূপে ম ম করছে কর্পূরের গন্ধ। দেখে মনে হয় যেন দোকান; কোনো দিনই আমার সাহস হয় নি যে জানতে চাইবো যে এই সব নিয়ে সে আসলে কী করতে চায়, পরিকল্পনা আছে কিছু? আমাদের খাওয়া-পরার জন্যে কোনো কাজ-কাম করবার দরকার পড়ে না, মাসে মাসে আমাদের খামারগুলো থেকে যা আয় হয়, তা খরচ খরচা করেও বরং আরো জমতে থাকে। কিন্তু আইরিনের একমাত্র পছন্দ উল বোনা, তাতেই তার দুর্দান্ত দক্ষতা। আর আমার ব্যাপার, ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। তার হাত জোড়া যেন রুপালি কোনো সামুদ্রিক প্রাণী। উল বোনা কাঁটা দুটো তার মধ্যেই মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মেঝেতে কটা ঝুড়ি, উলের গোল্লা লাফাচ্ছে তিড়িং বিড়িং। বেশ লাগে।
গোটা বাড়িটার নকশা ভুলি কী করে। খাবার ঘর, বসার ঘর তাতে সব কিছু সুন্দর কাপড়ে ঢাকা, লাইব্রেরি, আর বড় বড় তিনটে শোবার ঘর –একটা রদ্রিগুয়েজ পেনির দিকে মুখ। মোট-মাট বাড়ির এ দিককার অংশ হলো এই। একটা করিডোর, চলে গেছে বিশাল এক ওক-কাঠের দরজায়। ওটাই বাড়ির সামনের অংশ থেকে ওপাশটাকে আলাদা করে রেখেছে। এই সামনের অংশেই গোসলখানা, রান্নাঘর, আমাদের শোবার ঘর আর হল-রুম। বাড়িটাতে ঢুকতেই মিনা (কারুকাজ) করা টাইলসের বিস্তৃত লবি, তারপর পেটা-লোহার দরজাটা পেরিয়ে ঢুকতে হতো বসার ঘরে। আমাদের দুজনের দুটো শোবার ঘরের দরজা সেখান মুখোমুখি দুদিকে। উলটোদিকের করিডোরটা চলে গেছে বাড়ির পেছনের অংশে। সেই করিডোর ধরে এগিয়ে গেলে সামনে ওকের সুয়িং দরজা। তার ওপাশে বাড়ির বাকি অংশটা। তবে ওই দরজাটার ঠিক আগেই বাঁ দিকে ঘুরে গেলেই একটা সরু অলিন্দ পথ চলে গেছে রান্নাঘর আর গোসলখানার দিকে। দরজাটা খুললে তবেই বাড়িটার সত্যিকারের আয়তন ধারণা করা যাবে; দরজাটা বন্ধ থাকলে অনেকটা আজকালকার অ্যাপার্টমেন্টের মতোই, আজকাল যেমন বানানো হয় আর কী, ভালোমতো হাঁটাচলার জায়গাও থাকে না। আইরিন আর আমি সবসময়ই থাকতাম বাড়িটার এই দিকটায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ ছাড়া ওক-দরজাটার ওপাশে আমাদের তেমন যাওয়াই হতো না। না দেখলে তো বিশ্বাসই করা যাবে না আসবাবপত্রে কী পরিমাণ ধূলা পড়ে জমে থাকে। হ্যা, বুয়েনস আয়ারস খুবই পরিষ্কার একটা শহর তবে এখানে মানুষ-জন প্রচুর তাই এত ধূলা-বালি তাছাড়া আর কী। বাতাসে প্রচুর ধূলা একটু-আধটু বাতাসেই মার্বেল বসানো টেবিলের উপর আর চামড়া দিয়ে বানানো হীরক নকশার ডেস্কে ধূলা উড়ে আসে। পালকের ঝাড়ন দিয়ে ওসব পরিষ্কার করা খুব ঝামেলার ব্যাপার; ধুলোর উড়ে উড়ে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় ঠিকই তবে একটু পরেই আবার গিয়ে বসে পিয়ানো অথবা অন্য কোনো চেয়ার, টেবিল বা সোফায়।
আমার স্মৃতিতে সবসময়ই ভীষণ প্রখর ভাবে স্পষ্ট হয়ে আছে ঘটনাটা, ব্যপারটা ঘটে গেল একেবারে অকস্মৎ ও অবলীলায়। আইরিন তার শোবার ঘরে বসে উল বুনছিল, রাত আটটার মতো বাজে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হলো ম্যাটি খাওয়ার, তাই পানি গরম করতে হবে। নিচে নেমে আমি করিডোর ধরে ওক কাঠের দরজাটার কাছে চলে গেলাম, দরজাটা ভেজানো, তারপর হলের ভিতরে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, লাইব্রেরি বা খাবার ঘরের দিক থেকে কী যেন আমার কানে এলো। কিছু একটা শব্দ, এই আছে এই নেই আবার ফিস ফিস কন্ঠস্বর। একটা চেয়ার কার্পেটের ওপরে পড়ে গেলো নাকি চাপা স্বরে কারা যেন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। করিডোরের শেষে, এখান থেকেই দুদিকে দুটো শোবার ঘরের দরজায় যাওয়ার পথ, সেখানে গিয়ে পৌছাতেই বা দুই-এক সেকেন্ড আগে-পরে আমার কানে শব্দ গেলো। আর অপেক্ষা না করে আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দরজাটা চেপে ধরে আটকালাম, আমার শরীরের পুরোটা ওজন লাগিয়ে ঠেসে ধরলাম দরজাটা। ভাগ্য ভালো, দরজার চাবিটা এ দিকেই; তাছাড়া আরো নিরাপত্তার কথা ভেবে দরজার বিশাল ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিলাম। রান্নাঘরে গেলাম, কেতলিতে পানি চড়ালাম, তারপর যখন ম্যাটি বানিয়ে ট্রে-তে নিয়ে ফিরছি, আইরিনকে বললাম, “প্যসেজের দরজাটা আটকে দিতে হলো। ওরা পেছনের দিকটা দখল করে ফেলেছে।“
ও হাত থেকে উল বোনা কাটা-টাটা সব ফেলে দিলো। ক্লান্ত ভিরিক্কি চোখে তাকালো আমার দিকে। “সত্যি বলছো?“ আমি মাথা নাড়লাম, হ্যা সূচক।
“তাহলে তো,“ বলতে বলতে উল-বোনার কাঁটা দুটো আবারও তুলে নিল, ‘বেশ, তার মানে, আমাদেরকে এই দিকে থাকতে হবে।“
ম্যাটিতে চুমুক দিলাম খু সাবধানে, তবে আইরিন আবারও উল বোনা শুরু করতে করতে বেশ খানিকটা সময় নিলো। মনে আছে ও একটা ছাইরঙা সোয়েটার বুনছিল। সোয়েটারটা আমি ভারী পছন্দ করতাম।
প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন আমাদের বেশ কষ্টই হয়েছে, বেদখল হয়ে যাওয়া অংশটায় আমাদের দুজনেরই অনেক কিছু রয়ে গিয়েছে। যেমন, আমার ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের সংগ্রহ তখনও ওদিকের লাইব্রেরিতে পড়ে ছিল। আইরিনের দরকারি কিছু কাগজপত্র আর তার একজোড়া স্যান্ডেল, শীতকালে সবসময় ওটা পরে থাকত। আমার তামাক খাওয়ার কাঠের পাইপটা ফেলে এসেছি, সেও এক আক্ষেপ, আর আইরিন মনে হয় অতি পুরাতন এক বয়েম লেবুর জারক হারিয়ে মন খারাপ করে ছিল, ঘন ঘন সব মনে পড়তো (তবে ওই প্রথম কয়েক দিন মাত্র।) দেখা যেত হয়তো কোনো একটা ড্রয়ার বা আলমারি বন্ধ করে করেই একজন আরেক জনের দিকে দুঃখী দুঃখী চেহারা করে তাকিয়ে দেখছি।
“নাহ, এখানে নেই!”
ওপাশে যা যা খুইয়েছি ভাবছিলাম তার সাথে আরো একটা যোগ হলো। তবে তাতে কিছুটা সুবিধাও হয়েছিল। বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখার ঝামেলা খুবই কমে গেলো। এখন কখনো-সখনো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো, হয়তো সাড়ে নয়টা বেজে গেছে, তবুও এগারোটার মধ্যে সব কাজ-কাম শেষ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয় আমাদের। আইরিনের অভ্যাস হয়ে গেলো দুপুরের খাবার বানানোর সময় রান্নাঘরে এসে আমাকে সাহায্য করতো। তাই চিন্তা-ভাবনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম: আমি যখন দুপুরের খাবার বানাবো আইরিন তখন রাতের জন্য এমন কিছু একটা বানিয়ে ফেলবে যেন তা রাতে ঠান্ডাই খেয়ে ফেলতে পারি। এই ব্যবস্থায় আমরা দুজনেই বেশ খুশী হলাম, কেনো না সন্ধেবেলা শোবার ঘর ছেড়ে উঠে এসে রাতের রান্না-বান্না করা খুব বিরক্তিকর। এখন আইরিনের শোবার ঘরেই একটা টেবিলে আমরা রাতের ঠান্ডা খাবার সেরে ফেলি।
এই নিয়মে আইরিন আরো একটু বাড়তি সময় পেয়ে গেলো উল বোনার তাই সে সন্তুষ্ট। আমার অবশ্য বইগুলো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলাম কিন্তু তাই বলে আমার বোনের খুশীতে বাঁধ সাধতে চাই না। আমি বসে বসে বাবার ডাকটিকেটেগুলো আবারো সাজাতাম; বেশ খানিকটা সময় কেটে যেত। আমরা নিজেরাই নিজেদের সামান্য যা ছিল তাই দিয়েই নিজেদেরকে আনন্দে রাখাতাম যতটুকু পারা যায়। বেশিরভাগ সময় এক সাথেই আমরা কাটাতাম আইরিনের শোবার ঘরে, ঘরটাতে বেশ আরামের। কখনো সখনো আইরিন হয়তো বলত, ‘দেখ দেখি, আমি এখনই বানালাম, এই নকশাটা দেখতে তিন পাতাওলা গাছটার মতো না?“
হয়তো একটু পরেই আমি একটা বর্গাকার কাগজ ওর সামনে এগিয়ে ধরে ওকে অসাধারণ কোনো ডাকটিকেট মাহাত্ম্য দেখাতাম বা ইউপেন-মালমেটির একটা ডাকটিকেট দেখাতাম। আমরা কিন্তু ছিলাম বেশ, আস্তে ধীরে ও সব ভাবাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভাবনা-চিন্তা ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে। (আইরিন কখনো ঘুমের মধ্যে কথা বললে আমি সাথে সাথে সজাগ হয়ে উঠে জেগে বসেই থাকতাম। আমি কখনোই ওরকম আওয়াজ শুনি নি, না কোনো মূর্তির কন্ঠ না টিয়ার গলা, স্বপ্নের ভেতর থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর, কোনো মানব কন্ঠ এমন হতে পারে না। আইরিন বলেছে আমি নাকি ঘুমের মধ্যে খুব উল্টা পাল্টা ভাবে হাত-পা ছোঁড়া ছুঁড়ি করি, গা থেকে কম্বল ফেলে দিই। আমাদের দুজনের ঘরের মাঝখান বসার ঘর, তবে রাতে ঘরের ভেতরে সব শব্দ পরিষ্কারই শোনা যায়। আমরা একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের বা কাশির শব্দ তো পেতামই, এমনকি কখনো কখনো আলোর সুইচের অফ-অনের শব্দও টের পেতাম। প্রায়ই এমন হতো, তারপর দুজনের মধ্যে কেউই আর ঘুমাতে পারতাম না।
আমাদের দুজনের নৈশ উচ্চ-বাচ্চ ছাড়া গোটা বাড়িটায় আর সব কিছুই একেবারে নিরব। দিনের বেলায় তবু বাড়ির কাজকর্মের আওয়াজ হতো, উল বোনার কাঁটার ধাতব ঠুক-ঠাক, আর ডাকটিকেটের অ্যালবামের পাতা ওলটানোর আওয়াজ পাওয়া যেতো। মনে হয় আগেও একবার বলেছি, ওক কাঠের ঐ দরজাটা প্রকান্ড। রান্নাঘর আর গোসলখানা, দুটোই বাড়িটার দখলকৃত অংশের ঠিক লাগোয়া অংশ, সেখানে আমরা বেশ উচ্চৈ-স্বরে কথা-বাত্রা বলতাম। আইরিন মাঝেমাঝে সেখানে গুনগুনিয়ে গান গাইত। রান্নাঘরে বরাবরই খুব শোরগোল হয়, থালা-বাটি-গ্লাসের শব্দ, অন্যান্য সব শব্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতো সে সব শব্দ। রান্নাঘরে আমরা কখনোই চুপচাপ থাকতাম না। তবে আমাদের ঘরে বা বসার ঘরে ফিরে এসে বসলেই, বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে উঠতো। একটু মাতাল হলেই আমরা সারাটা ঘর আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম, বুঝেশুনে সাবধানে পা ফেলে চলতাম যেন কেউ কাউকে বিরক্ত না করে বসি। মনে হয় এর কারণ আইরিন ঘুমের মধ্যে কথা বলা শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘুম আচমকা ভেঙ্গে যেতো।)
অল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া বাদ বাকিটা প্রায় প্রতিটা দিনই আগের দিনের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। সে রাতে আমার খুব পিপাসা পাচ্ছিল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে আইরিনকে বললাম, পানি খেতে যাচ্ছি রান্নাঘরে। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই (আইরিন তখন উল বুনছে) রান্নাঘরের দিকে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটা রান্নাঘর বা গোসলখানা থেকেই আসছে। ও কোণের বন্ধ প্যাসেজটায় শব্দ খুব অল্প। আইরিনের চোখে পড়লো আমি এগোতে গিয়েও কেমন হুট করে থেমে গেলাম। কোনো কথা না বলে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়াল।
আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছি। শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বুঝতে পারছি ওরা ওক কাঠের দরজার এপারে আমাদের এদিকটাতে এসে পড়েছে। হয় রান্নাঘরে, নয়তো গোসলখানায়, না হলে পাশের হল ঘরে আমাদের একেবারে কাছে চলে এসেছে। আমরা আর কেউ কাউকে ফিরে তাকিয়ে দেখবার জন্যে সময় নষ্ট করলাম না। আইরিনের এক-হাত ধরে জোর করে তাকে টেনে নিয়ে এক দৌড়ে চলে আসলাম একেবারে পেটা-লোহার দরজাটার কাছে। আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। তখনও আমাদের পেছন পেছন গুনগুন কন্ঠস্বর, তবে বেশ খানিকটা জোরে। দড়াম করে বন্ধ করলাম দরজাটা। দুজনে এসে দাঁড়ালাম খোলা চত্বরে। আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না।
আইরিন বলল, “ওরা আমাদের এদিকটাও নিয়ে নিল!“ ওর হাত থেকে বোনা উলের গোলা গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে দরজার নিচে দিয়ে গলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আইরিনের চোখে পড়লো উলের গোল্লাটা দরজার ওপাশে রয়ে গেছে, বোনা অংশের দিকে একবারো না তাকিয়ে সে ওটা ফেলে দিলো হাত থেকে।
কন্ঠে হতাশা, জানতে চাইলাম, “সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসতে পেরেছিলে?“
“নাহ্, কিছুই আনতে পারি নি।“ এখন আমাদের সাথে যা আছে এ-ই আাছে। মনে পড়ে গেলো আমার শোবার ঘরের আলমারিতে পনের হাজার পেসো আছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাতে অবশ্য তখন আমার ঘড়িটা পরেই ছিলাম, তাকিয়ে দেখলাম রাত এগারোটা। আইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরলাম (মনে হলো ও কাঁদছে) রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম ওভাবেই। বাড়িটা ছেড়ে চলে আসবার ঠিক আগে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল; সদর দরজাটা শক্ত করে চেপে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নর্দমায়। আমি চাই নি কোনো হতচ্ছাড়া নচ্ছার বদমায়েশ বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাড়ি-ঘরের সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারে, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের গোটা বাড়িটাই বেদখল হয়ে গেলো।
বেদখল, জুলিও কোর্তাজার
